দেশে মাথাপিছু ঋণের বোঝা ৪০ হাজার টাকা

বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক অংশে তিন-চার শ’ বছর আগে জনসংখ্যা ছিল প্রায় দুই কোটি। এক শ’ বছর আগে এ অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল তিন কোটি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় এর সংখ্যা ছিল চার কোটি। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সময় ছিল সাড়ে সাত কোটি। গত সাড়ে চার দশকে তা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে।

এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ অভিবাসী হয়ে মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্টেলিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশের মতো এত জনবহুল এলাকা বিশ্বে আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা বিশ্বে অষ্টম, কিন্তু বাংলাদেশে এত বেশি মানুষ বসবাস করছে; যা বিশ্বে বিরল। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য চাই খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ও সমবণ্টনের সুব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে আমাদের চরম ব্যর্থতা রয়েছে। তার প্রমাণ, বাংলাদেশ এখনো একটি আমদানিনির্ভর রাষ্ট্র। আমাদের বাণিজ্য ক্ষমতা নেই। রফতানির চেয়ে আমদানি চার গুণ বেশি। এ কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যে বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আমরা ঋণ দিতে পারি না, অথচ অভ্যন্তরীণ উৎস এবং বিদেশ থেকে কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করি। সেই ঋণ সুদ-আসলে পরিশোধ করতে হয়। নবজাতক শিশু, সে-ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বাংলা মায়ের কোলে জন্মায়। মাথাপিছু ৪০ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত এই শিশু ঋণের জালে আটকা পড়ে আছে।

২০১৭ সালে শুধু বেসরকারি খাতে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ ছিল সাড়ে ১১ শ’ কোটি ডলার। বিদেশী এ ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৪ শতাংশ। বেসরকারি খাতে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে, যা অর্থনীতিতে উদ্বিগ্নতা বাড়াচ্ছে। ২৬ এপ্রিল ২০১৮ রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়ামে ‘প্রাইভেট কমার্শিয়াল বোরোয়িং ফ্রম ফরেন সোর্সেস ইন বাংলাদেশ : অ্যান অ্যানাটমি’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণের ১১ ধরনের ভীতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ফরেন কারেন্সি রিস্ক, মোর‌্যাল হ্যাজার্ড, কস্ট অব বোরোয়িং, ফরেন কারেন্সি বোরোয়িং, লোকাল বিজনেস অর্গানাইজেশন, লোন ইউটিলাইজেশন, পলিসি আনসার্টিনিটি, পলিসি সাপোর্ট, ভেরিফিকেশন অব অ্যাপ্লিকেশন, বোরোয়িং ফ্রম অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট এবং ঋণ অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা। এতে আরো বলা হয়েছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৪ শতাংশ বিদেশী ঋণ পোশাক খাতে। এরপর বিদ্যুতে ২১ শতাংশ, সুয়েটারে ১৬, ডায়িং ও নিট গার্মেন্টে ১২, টেক্সটাইলে ১১, প্লাস্টিকসে ৫, সেবায় ৩ এবং ওষুধে ২ শতাংশ। তথ্যে আরো উঠে এসেছে, বিশ্বের অনেক দেশ বেসরকারি খাতে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককেই তদারকির ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশী ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ তাদের স্থানীয় ঋণও পরিশোধ করতে দেখা গেছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। বিদেশী ঋণে বহু ধরনের ঝুঁকি বিদ্যমান। এ কারণে ব্যাংকারদের পাশাপাশি গ্রাহকদেরও ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। মোটকথা রেমিট্যান্স, রফতানি ও উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদেশী ঋণ নেয়ার অনুমোদন দিতে হবে। বিদেশী ঋণের অপব্যবহার ঘটলে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে নজরদারি বাড়াতে হবে।

৩০ এপ্রিল ২০১৮ একটি বহুলপ্রচারিত দৈনিক জানিয়েছে, রফতানির তুলনায় ভারত থেকে ১০ গুণ পণ্য আমদানি করা হয়। এফবিসিসিআইর সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ ২৯ এপ্রিল ২০১৮ রাজধানীতে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে স্থলবন্দর সমস্যাবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে রফতানির ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। কারণ, তাদের চাহিদা কম। চাহিদা বাড়ানোর অদম্য প্রচেষ্টা চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, তাহলেই বেশি পণ্য রফতানি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা বড় অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরো ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে। এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না। বলতে গেলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত এখনো অনগ্রসরমান। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে পুরো দেশের মানুষের ওপর ছয় লাখ ৫৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। আগামী অর্থবছর (২০১৮-১৯) নতুন করে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেবে সরকার, যার দুই-তৃতীয়াংশই আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। সুদসহ আগের বছরগুলোর মূল টাকাও সরকার প্রতি বছর পরিশোধ করে আসছে। পরিশোধ না হওয়া টাকা জমতে জমতেই ঋণের বোঝা পাহাড়সম দাঁড়িয়েছে।

আগামী অর্থবছরে (২০১৮-১৯) শেষে দেশী-বিদেশী মিলিয়ে রাষ্ট্রের মোট ঋণ দাঁড়াবে সাত লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে দেশের ভেতর থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ চার লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ দুই লাখ ৯০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে।

বাজেট পেশের দুই দিন আগে গত ৩০ মে ২০১৭ দেশের জনসংখ্যার একটি হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএস আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, গত ১ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। সে হিসাবে আগামী অর্থবছর (২০১৮-১৯) শেষে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ কোটি ৫০ লাখ এবং মাথাপিছু ঋণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। বর্তমানে মাথাপিছু ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা। আগামী অর্থবছরের (২০১৮-১৯) জন্য দেয়া চার লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট দুই লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ পরিশোধে রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদই ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ অর্থই ব্যয় হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হবে সঞ্চয়পত্রের সুদে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হবে মেয়াদি ঋণের সুদে। প্রস্তাবিত বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দের অঙ্কের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা কত বেশি। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, সস্তা সুদের বৈদেশিক ঋণ নিতে পারছি না আমরা একশ্রেণীর সরকারি কর্মচারীর অযোগ্যতার কারণে।

২৬ এপ্রিল ২০১৮, প্রথম আলোর আপডেট নিউজ ছিল গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) সুদ পরিশোধে সরকারের খরচ হয়েছিল ৩৩ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। ১০-১২ শতাংশ লোকের কাছে বিক্রি হচ্ছে মোট সঞ্চয়পত্রের ৮৫ শতাংশ। সুদ পরিশোধেই চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের খরচ হবে ৩৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ খাতে গত অর্থবছরের চেয়ে বাড়তি খরচ হবে চার হাজার কোটি টাকা বেশি। উচ্চ সুদে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া, বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং নামমাত্র সুদে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিতে না পারার কারণেই সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হবে এই বিপুল অঙ্কের টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। এ কারণেই ব্যাংক খাতে এই দুরবস্থা। ব্যবসায়ীরা টাকা পান না, আর নতুন নতুন ব্যাংক স্থাপনের আবেদন।

অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নিয়ে সরকার অর্থনীতিকে গভীর সঙ্কটে ফেলেছে। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। গত ১ মে ২০১৮ ঢাকার কর অঞ্চল-৩ আয়োজিত আয়কর ক্যাম্প ও করদাতা উদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা হতে পারে। মিরপুর কনভেনশন সেন্টারে এই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন উন্নতি করছে। এক সময় বাংলাদেশ সাহায্যনির্ভর দেশ ছিল। এখন আগের মতো আর সাহায্য নিতে হয় না। আসলে কি তাই, বাস্তবতা কী বলছে- অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বাজেটের একটি বড় অংশ কেন ঋণ নেয়া হয় এবং সেই ঋণের ওপর ৪০ হাজার কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হয়? এরপর থাকে ঘাটতি বাজেট, যা বাজেটের প্রায় ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। সত্যি বলতে কি, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কর্মসৃজনের বাজেট তৈরি করেছিলেন বলেই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে মানুষ কাজ করে খেতে পারছে। বড় অঙ্কের বাজেট দিয়ে কী হবে। মানুষ চায় এমন বাজেট, যে বাজেটে একজন মানুষও বেকার থাকবে না; কিন্তু দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এখনো তিন কোটি।

শিরোনাম